এটি একটি গল্পগ্রন্থ, যাতে মোট তেরোটি ছোটগল্প স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে দশটি লেখা সাধু ভাষায়, এবং তিনটি লেখা চলিত ভাষায়। তবে সাধু ভাষার যে-রূপ গল্পগুলোতে পাওয়া যায়, সে-রূপ মহিউদ্দিন মোহাম্মদের নিজস্ব চিন্তাভাবনার অংশ।
বিভিন্ন সামাজিক অসঙ্গতি, দ্বিচারিতা ও ধর্মীয় কুসংস্কার নিয়ে লেখা গল্পগুচ্ছ "টয়োটা করোলা।" মহিউদ্দিন মোহাম্মদ অপ্রিয় বিষয়ে কথা বলার সৎসাহস ও দুঃসাহস রাখেন। গল্পটা শুধুই মাধ্যম। ভেতরের বার্তাগুলোই প্রধান। ভালো লেগেছে।
এই গ্রন্থখানির অনন্য বিষয় হচ্ছে এর ভাষাশৈলী। আধুনিক গরু রচনা সমগ্র পড়ার কারণে আগে থেকেই জানতাম মহিউদ্দিন মোহাম্মদের লেখার কারণ। কিন্তু এখানে যে বিষয়টি ভাল লেগেছে তা হচ্ছে সচেতনভাবে আটপৌরে কথ্য ভাষা আর লিখিত ভাষার পৃথকীকরণ। বিষয়টা আইরনিক হিসেবে বিবেচ্য হতে পারে, কিন্তু গোটা বইয়ে আমার পড়ে ভালো লেগেছে ভূমিকাটা। মোট ১৩টা গল্প আছে। তবে শেষ দু'টো বাদে অন্য গল্পগুলো গতানুগতিক অর্থে গল্প কিনা সেই সন্দেহ রয়ে যায় মনে। বিষয়বস্তু বিবেচনাতেও গল্পগুলোকে অভিনব বলা যায় না। চাইলে প্রথম দশটা গল্পকে এক ছাতার তলে আনা যেত। তবে লেখকের ইচ্ছে, তিনি যা করবেন। এই দশটা গল্পই চমৎকার ভাবনার খোরাক হতে পারে। সমাজ/বিশ্বের বর্তমান সময়ের বিভিন্ন সমস্যাই গল্পগুলোর উপজীব্য। যারা গল্প পড়ে ভাবতে চান, তাদের জন্যে টয়োটা করোলা(অন্যদের জন্যেও)।
লেখক মহিউদ্দিন মোহাম্মদ 'আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র' লিখে ইতিমধ্যেই বেশ আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। তাঁর লেখনী সম্পর্কে ধারণা আমার আগে থেকেই ছিলো। এবার তিনি এসেছেন গল্পগ্রন্থ 'টয়োটা করোলা' চালিয়ে।
গল্পসমূহ কোন জঁরায় ফেলা দরকার তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে লেখকের মতে এ সকল স্টোরি 'অ্যাবস্ট্রাক্ট রিয়ালিজম' জঁরায় কিছুটা পড়েছে। মানে মহিউদ্দিন মোহাম্মদ 'বিমূর্ত বাস্তবতা' এর কথা বলেছেন মনে হয়। তাও লেখকের মতে পুরোপুরি ঐ আঙ্গিকের নয় এই সকল গল্প।
'বিমূর্ত বাস্তবতা' শুনে পাঠকের ঘাবড়ে যাওয়ার কোন কারণ দেখছি না। কারণ লেখক 'টয়োটা করোলা' গ্রন্থে ভাষা বিষয়ক বিশুদ্ধতাবাদে ভুগেন নি। তিনি বেশিরভাগ গল্প তাঁর নিজস্ব স্টাইলের সাধু ভাষায় রচনা করেছেন, এবং সেই সাধু ভাষা পাঠকের সাথে বেশ যোগাযোগপূর্ণ। লেখক আটপৌড়ে ভাষায় সাহিত্য করতে চান নি।
উক্ত গ্রন্থের স্টোরি গুলো শুধুমাত্র স্টোরি নয়। অর্থাৎ কাহিনি লিখেই লেখক ক্ষান্ত হতে চান নি। গল্পকথনে কাহিনির বাইরে গিয়ে মহিউদ্দিন মোহাম্মদ পরিষ্কার কিছু বার্তা দিয়েছেন। বাঙালির সামাজিক-রাষ্ট্রিয় যাপনে যে বিভিন্ন পশ্চাৎপদতা, ধর্মের বা জাতীবাদের নামে ভয়ানক মব মেন্টালিটিকে সজোরে আঘাত করেছেন লেখক। পপুলিজম বা লোকরঞ্জনতাবাদের বিপক্ষে যথারীতি একজন প্রথাবিরোধী / প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক হিসেবেই তাকে পাওয়া গেছে।
মহিউদ্দিন মোহাম্মদের গদ্য দারুন। গল্পকার হিসেবে তিনি বেশ ইন্টারেকটিভ। প্রায় প্রতিটি গল্প বিভিন্ন প্রাণী, জড় পদার্থ এবং মানুষজন, যেসকল ত্রুটিপূর্ণ সূত্রের উপর সমাজ-রাষ্ট্র চলছে সেসবের সৎ বয়ানই দেয়ার চেষ্টা করেছে। গল্প ধরে ধরে আলাপ দেয়া যেত তবে সেই দারুন রিভিউর কর্মটি প্রকাশক শাহীদ হাসান তরফদার নিজেই সেরে ফেলেছেন উক্ত গ্রন্থে। 'লেখকের কথা' ও বেশ ইন্টারেস্টিং।
মহিউদ্দিন মোহাম্মদের বইটির প্রতিটি গল্পই সুখপাঠ্য এবং দিকনির্দেশক। অর্থাৎ কেচ্ছা-কাহিনির এর উর্ধ্বে গিয়ে বিবদমান বাস্তবতাই মূর্ত হয়েছে বারবার। ভাষা যেহেতু চিন্তার চেয়েও অগ্রগামী তাই সেই ক্ষেত্রে লেখক মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ভাষার ক্ষেত্রে যেমন পাঠকের সহ্যসীমার বাইরে তিনি যান নি। তবে সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন নির্মানবিকতা যেভাবে লেখক পয়েন্ট আউট করেছেন, আশা করছি ভবিষ্যতে এসব থেকে পরিত্রাণের পথের ইশারাও তাঁর দিক থেকে আসবে। কারণ বাংলাদেশে প্রথাবিরোধীতা যখন প্রথায় পরিণত হয়ে যায় তখন সমাধানে অপারগ একদল জনবিচ্ছিন্ন এবং উন্নাসিক মানুষজনই পাই আমরা। অতীত অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। মহিউদ্দিন মোহাম্মদের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা দেখে এসব কথা বললাম, কারণ তিনি মূলত জনপ্রিয় ধারার লেখক নন।
সঙ্ঘবদ্ধ মানুষ মূলত স্যাভেজ, মব মেন্টালিটির। সেই স্যাভেজারি লেখকের রাইটিং এর হাত ধরে ঘুরেফিরে এসেছে প্রতিটি গল্পে। বইটির সবচেয়ে আইরনিক বিষয় হল বেশিরভাগ গল্পের থিম এক ছাদের নিচেও লেখক আনতে পারতেন। মানে কমপক্ষে দশটি গল্পের থিম প্রায় একই। অবশ্য প্রথায় এবং প্রতিষ্ঠানে আঘাত হানা যদি লেখক মূল কর্তব্য মনে করেন তাহলে ঠিক আছে। প্রকৃত লেখক মাত্রই তো প্রতিবাদী এবং প্রথা / প্রতিষ্ঠান বিরোধী।
প্রথার বিরুদ্ধে এই লড়াইপূর্ণ গল্পগ্রন্থ পাঠ করে অবশ্য অনেকেই ক্ষিপ্ত হতে পারেন। কারণ লেখালেখি বিষয়টাই পাঠকের সাথে যোগাযোগের সমস্যাপূর্ণ। এক একটি লেখাকে ব্যক্তিভেদে বিভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা যায়। তবে যারা ভাবতে চান, নিজেকে অভ্রান্ত মনে করেন না, অনেক কিছুই আনলার্ন করে নতুন করে শিখতে চান, এবং চমৎকার গদ্য পড়তে আগ্রহী এ বইটি তাদের জন্য।
সেই হিসেবে মোটাদাগে এ বইটি খুব সম্ভবত ভবিষ্যতের জন্য লিখা।
বই রিভিউ
বই : টয়োটা করোলা লেখক : মহিউদ্দিন মোহাম্মদ প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২৩ প্রকাশনা : জ্ঞানকোষ প্রকাশনী প্রচ্ছদ : সব্যসাচী মিস্ত্রি জঁরা : গল্পগ্রন্থ রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ
"আধুনিক গরু রচনাসমগ্র" বইটা পড়ে লেখকের ফ্যান না হয়ে থাকতে পারি নাই। তার লেখার ধরণ, আসলেই সাহিত্য জগতে নতুন কিছু। সেই হিসাবে "টয়োটা করোলা" বইটা নিয়ে আমার শুরু থেকেই এক্সপেকটেশন ছিল বহুত। বইটাতে আমাদের সমাজব্যবস্থাকে বিভিন্ন বিষয়-বস্তুকে জীবনদানের মাধ্যমে গল্পের আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। সত্যি, লেখকের মস্তিষ্ক বর্তমান মানুষের তুলনায় কয়েকগুণ এগিয়ে চলে। লেখকের গল্পবলার ধরণ আর মারপ্যাচ ধরতেও একটা বুঝদার ব্রেন থাকা জরুরি। লেখক আমার পুরো এক্সপেকটেশন পূরণ করতে পেরেছে। দারুণ উপভোগ্য বই এটা।
গল্প, গল্পের ভাষায় অভিনবত্ব আছে। স্যাটায়ারধর্মী গল্প বেশিরভাগই। তবে গল্পগুলো বেশিরভাগ-ই আমাদের চারপাশের অবস্থা, পরিস্থিতিকে উপজীব্য করে লেখা বলে গল্পে নতুনত্ব তেমন নাই। তবে লেখার ধরন ও উপস্থানের ভঙ্গি অবশ্যই অনন্য। আধুনিক রীতিতে সাধু ভাষা প্রয়োগের এক্সপেরিমেন্টটাও ভালো হয়েছে। শেষের ড্রাইভিং লাইসেন্স গল্পটিতে বেশি মজা পেয়েছি। ৩.৫/৫
বরাবরের মতোই স্যাটায়ার আর রূপক গল্পের মাধ্যমে সমাজ, মোর স্পেসিফিকালি বলতে গেলে বঙ্গসমাজের চিত্র লেখক সুনিপুণভাবেই তুলে ধরেছেন। গল্পগুলোতে ভাষার বৈচিত্র্য প্রশংসনীয়! সবচাইতে বেশি ভালো লেগেছেঃ আমাদের দাদী, বিজ্���ান ছাড়া একদিন, ঈশ্বরের টেলিফোন - এ তিনটি গল্প।
৩.৫ একচুয়ালি। (কিছু গল্প খুব একটা যুতসই লাগেনি আমার কাছে)
ছোটগল্পের বই। বেশ ইন্টারেস্টিং ছিলো বইটা। সমাজের যে অবস্থা নিয়ে আমরা ফিসফিস করে সমালোচনা করি সেটাই গল্প আকারে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছেন লেখক। বেশ ভালো লেগেছে গল্পগুলো। ধর্মীয় সংকীর্ণতা,সামাজিক কুসংস্কার, রাজনৈতিক অপব্যবহার, সামাজিক সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সাধুভাষায় স্যাটায়ারধর্মী লেখা। এরকম স্যাটায়ার সাধারণত আহমদ ছফার গল্পে/লেখাতে পাওয়া যায়। আর এই ধাঁচের সমালোচনা মূলক লেখা আমার খুব পছন্দের। (মিষ্টিকরে আইক্কা ওয়ালা বাঁশ দেওয়ার মতো লেখা বলি আমি এটারে) সাধু রীতিতে লেখা বিধায় পড়তে বেশ মজাই লেখেছে আমার ব্যক্তিগত ভাবে।
প্রতিটা গল্পের ভেতরের মেসেজগুলো খুব সুন্দর ছিলো। বাস্তবিক জগতের সাথে মিলিয়ে লেখা বোঝাই যায়। মোট ১৩ টা গল্পের মধ্যে "একটি পুকুর কি বলিতে চায়?", "মসজিদের চিঠি", "ভণিতা", "জার্নি বাই বাস", "ড্রাইভিং লাইসেন্স" ভালো লেগেছে সবথেকে বেশি।
এইতো, মহিউদ্দিন মোহাম্মদের প্রথম বই পড়লাম। লেখকের প্রতি একটা অন্যরকম ভালোবাসা জন্মালো। এমন ব্যক্তিক্রমি লেখক যুগে যুগে আমাদের দরকার। নিষিদ্ধ লেখকদেরর মধ্যে এই ভদ্রলোকের নাম যেতে মনে হয় না বেশিদিন লাগবে। আহমদ ছফার মতোই আলোচিত হোক উনি সেই শুভকামনা করি। শীঘ্রই "আধুনিক গরু রচনা সমগ্র" পড়ে ফেলতে হচ্ছে এবার। হ্যাপি রিডিং🌸
দোষটা আমারই হয়ত। আমারই শুচিবায়ু। শুচিবায়ু বলা যাবে কিনা তাও জানি না। ওসিডি বলে মনে হয়। বইয়ের এই মাথা থেকে সেই পা পর্যন্ত পড়া। ব্লার্বের কাহিনিসংক্ষেপ, লেখক পরিচিতি, শংসাবচন, বিবিধ সংস্করণের দিনতারিখ, প্রচ্ছদ শিল্পীর নাম, কপিরাইট, আইএসবিএন - সব। এমনকি যে বইটি পড়ছিলাম সেটিতে প্রকাশক মিঃ তরফদারের ‘প্রকাশকের কথা’ও। নিজেকেই জিজ্ঞেস করলাম এটুকু বাদ দিলে কী হ’ত? সুস্বাদু খাবার মুখে নিয়ে দাঁতের নিচে এলাচ পড়লে থু করে সেটা ফেলে দেওয়া যায়। কিছু একটা পড়লে ওটা ‘নাপড়া‘ করা মুশকিল। উনি বলছেন, সরাসরি তুলে দিচ্ছিঃ
“অনেক কাঁচা পাঠক আছেন, যারা নাম পুরুষে বর্ণনা করা গল্পের ভাষ্যকারের কন্ঠকে লেখকের নিজস্ব প্রাবন্ধিক কন্ঠ মনে করে তালগোল পাকাতে পারেন। গল্পের চরিত্রকে তারা গুলিয়ে ফেলতে পারেন লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের সাথে। কেউ কেউ প্রেক্ষাপট এবং দার্শনিক বোধ অনুধাবন করতে গিয়ে পরিচয় দিতে পারেন ব্যর্থতার।”
জনাব কন্ডাসেন্ডিং পিস অফ * আরো বলছেনঃ “ধীরে লয়ে এর রস আস্বাদন করতে হবে। পাঠ করতে হবে বারবার। প্রতি পাঠেই এগুলো ধরা দিতে থাকবে নতুন আঙ্গিকে।”
এরপরে প্রকাশক প্রতিটি গল্পের সারসংক্ষেপ দিয়েছেন ‘কাঁচা পাঠক’দের জন্য।
গল্পগুলো পড়ে এটুকু বুঝেছি যে লেখকের রুচিতে প্রকাশকের কথাগুলো আরো বেশি আঘাত করার কথা। আশা করি পরের সংস্করণে প্রকাশকের কথা একটি সূচিপত্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে।
প্রকাশকের গল্পসংক্ষেপগুলো পড়ে মনে হয়েছিল ডাঃ লুৎফর রহমানের (মাগুরা জেলার পারনান্দুয়ালী গ্রামে যাঁর জন্ম, যিনি লিখেছেন ‘মহৎ জীবন’, ‘উন্নত জীবন’, ‘সত্য জীবন’, ‘উচ্চ জীবন’, ‘যুবক জীবন’ ইত্যাদির মত অনবদ্য সব প্রবন্ধের বই) লেখা পড়তে যাচ্ছি হয়তবা। অথচ লেখাগুলো বেশ রসসমৃদ্ধ, উপভোগই করেছি লেখনির কারণে। লেখকের নৈতিকতা, দর্শন আর ভাবনার সাথে কোথাও সেভাবে ব্যক্তিগত চিন্তার সংঘর্ষ না হওয়ার কারণেই হয়তবা।
দুর্নীতি, ধর্মান্ধতা আর সংকীর্ণ মানসিকতার নগ্ন রূপ উন্মোচন করেছিলেন "আধুনিক গরু রচনাসমগ্র" বইতে। এটাকে সে বইয়েরই সংযোজিত সংস্করণ বলা যায়। একই ধাচ, একই ব্যাপারের পুনরাবৃত্তি মনে হলো।
বইটা ভালো তবে লেখক���র পূর্বের বই আধূনিক গরু রচনার মত ততটা চমকপ্রদ নয়। আগের বইটায় বিভিন্ন বিষয়ে লেখকের দর্শন নতুন ভাবে ভাবতে বাধ্য করেছিলো, এই বইতে তেমন নতুন কিছু পাওয়া যায় নি। সমাজব্যাবস্থার অসঙ্গতি গুলো গল্পের আকারে তুলে ধরা হয়েছে। এটুকুই।
মেঘ করিয়াছে, সহসাই বৃষ্টি নামিবে। কৈ মাছগুলি বড়ো বেয়াড়া হইয়া উঠিয়াছে। একটু বৃষ্টির দেখা পাইলেই আমাকে ছাড়িয়া যাইতে চায়। মনে হয় মানুষের সংস্পর্শ পাইয়া ইহারাও কিছুটা মানুষের মত হইয়া গেছে। না হইলে হঠাৎ মৎস্যগুলি এমন মানুষের মত আচরণ করিবে করিবে কেন? যে অন্ন দিলো, আবাস দিলো, জগদীশ হইয়া দুর্দিনে আগলাইয়া রাখিলো, তাহাকে উহারা কতো সহজেই ভুলিয়া যাইতে চায়। - একটু পুকুর কী বলিতে চায়?
মহিউদ্দিন মোহাম্মদকে নিয়ে আর যাই থাকুক, তাএ লেখার হাত নিয়ে সন্দেহ পোষণ করার কোনো অবকাশ নেই। তিনি আদর্শ গরুর রচনায় যেমন দুর্দান্তভাবে লিখেছিলেন, টয়োটা করোলাতেও তার সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখেছেন বলেই মনে হয়েছে। তার প্রকাশভঙ্গী খুবই আকর্ষণীয়। তার কিছু লেখা হয়ত অনেকেরই পছন্দ হবে না, কিন্তু কিছু গল্প আবার আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবেই। যাদের গরু রচনা ভালো লেগেছিল, তারা নিঃসন্দেহে পড়তে বসতে পারেন।
রিডার্স ব্লকের মধ্যে থেকেও এতো দ্রুত শেষ করে ফেললাম। আমার পড়ার গতির মাপজোক আমি নিজেও বুঝি না।
মহিউদ্দিন সাহেবের নিজস্ব সাধু ভঙ্গিটা চমৎকার সুর-তালে গল্পের শেষ প্রান্ত অবধি পৌঁছে দেয়। লেখার ভাষা ও ভঙ্গির জন্য এই বইটা এক অনন্য জায়গা দখল করে থাকবে। কিন্তু এবারকার গল্পগুলোতে আগের ঐ 'চিকন মাইর' গুলো মিসিং। যেন আগেরবারের অভিনব অবজার্ভেশন গুলো এবার লাপাত্তা। লেখক যা দেখছেন আমরাও রোজ তা-ই দেখে কমবেশি অভ্যস্ত।
কিছু জায়গায় গল্পের চালচলন খুব ক্লিশে মনে হলো। ভাব-ভঙ্গিতে এবং পরিবেশনায় এরকম ইউনিক একটা বইয়ের জন্য 'ক্লিশে' হওয়াটা একটা বড় ড্র-ব্যাক। ড্র-ব্যাকের সবচেয়ে কুচ্ছিত শিকার হয় "বিজ্ঞান ছাড়া একদিন" গল্পটা। বইয়ে ওটাই একমাত্র দুর্বল গল্প ঠেকে।
এছাড়া বাকি গল্পগুলো চলনসই। "ভণিতা" ভালো লেগেছে। সেরা গল্পটা নিঃসন্দেহে "টয়োটা করোলা" স্বয়ং। "জার্নি বাই বাস"ー যদিও সোশ্যাল ক্রিটিক ক্যাটাগোরিতে পড়ে না তবুও পড়ে ভালো লেগেছে।
এবার একটু এভারেজ খেলেছেন লেখক। তবে মহিউদ্দিনের সাহেবের লেখা আমাদের আরো দরকার। মগজে মাঝেমধ্যে এমন ঘষামাজার দরকার আছে বৈকি।
বইটায় সবচেয়ে ভালো লেগেছে ভাষার ব্যবহার। গুরুচণ্ডালী নামক কঠিন ব্যাকরণিক বাধাকে লেখক আমলেই নেননি। কিন্তু গল্পের বাচনভঙ্গি সাবলীল এবং স্বচ্ছন্দ। গল্পের প্রেক্ষিত হয়ে উঠে এসেছে সমাজ ও সমাজে ছড়িয়ে থাকা অপ্রাসঙ্গিক, অন্যায্য ও অনৈতিক বিষয়গুলো। ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে সেগুলোর উপস্থাপন এবং তীক্ষ্ণ ও গভীর দৃষ্টিতে পাঠককে দেখানোর প্রচেষ্টা মুগ্ধ করেছে।
ঠিক প্রচলিত ছোটগল্প নয়। যেন বর্ণনামূলক (narrative) ছোটগল্পের সাথে প্রবন্ধের কিছু কাঁচামাল মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। অধিকাংশ লেখায় সাধুভাষার প্রয়োগ গল্পগুলোয় একটা চিরায়ত গন্ধ লেপে দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছের দ্বিতীয় গল্প "রাজপথের কথার" সাথে খানিকটা গঠনের মিল পাওয়া যায়। তবে এইগল্পগুলোয় লেখকের মুক্তচিন্তা, সামাজিক অসঙ্গতি, মানুষের স্বভাবের দ্বিচারিতা বেশ চিন্তাগ্রাহ্য হয়ে উঠে এসেছে।
লেখকের মনে করেন, বাংলা সমৃদ্ধ সাহিত্য সৃষ্টিতে সাধুভাষার একটা মুখ্য ভূমিকা ছিল। এই ভাষাকে পুরোপুরি বর্জন করে সাধারণ মানুষের ভাষা দিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হলেও সেটা সাহিত্য মানের উৎকর্ষতায় উৎরাতে পারবে না। এক্ষেত্রে লেখকের বক্তব্য, "মানুষ আটপৌরে কথ্য ভাষাকে সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার ভাষা ভাবছে। শিল্প-সাহিত্যের শূণ্য গোয়ালে গরু সেজে হানা দিচ্ছে ছাগল।" বর্তমান সমকালীন সাহিত্যমানের দিকে নজর দিলে লেখকের বক্তব্যের সাথে পুরোপুরি দ্বিমত হওয়া কঠিন বৈকি।
মোট ১৩ টি গল্প দিয়ে সাজিয়েছেন লেখক মহিউদ্দীন মোহাম্মদ নিজের 'টয়োটা করোলা' গল্পগ্রন্থটি। এগুলোর ভেতর ১০টি লিখেছেন সাধু ভাষায় আর তিনটি চলিত। তবে সাধু শুনে ভয় পাবার প্রয়োজন নয়। বঙ্কিমীয় সাধু ভাষা নয়। রবীন্দ্রনাথ যেমন নিজের জন্য সাধু ভাষার সংস্করণ তৈরি করে নিয়েছিলেন। লেখক মহিউদ্দীনও এই সাহসটি দেখিয়েছেন। বর্তমান সময়ের সাথে উপযোগী একটা সাধু ভাষার সংস্করণ উনি সৃষ্টির প্রয়াস করেছেন ওনার এই ১০ টি গল্পে।
আমি সূচিপত্র অনুসরণ করে পড়িনি। নাম চিত্তাকর্ষক হওয়াতে প্রথমেই পড়ি "মানুষ ও বানরের পার্থক্য"। বানরদের আপাতদৃষ্টিতে বিশৃঙ্খলিত সমাজের ভেতরের শৃঙ্খলার সাথে তথাকথিত শৃঙ্খলিত মানবসমাজের তীব্র বিশৃঙ্খলাকে আঙুল দিয়ে ষ্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছেন লেখক। মানুষের বানরের সাথে নিজের আত্মীয়তা নিয়ে প্রশ্ন, তর্ক, দ্বন্দ থাকতে পারে কিন্তু বানরের মানুষ আত্মীয় হওয়া নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই।
"মসজিদের চিঠি" বেশ সাহসী একটা গল্প। ধর্মপ্রাণ অনেক মানুষকে গল্পটি দুভাবে নাড়া দিতে পারে। দুই ধরনের আবেগর হরমোন নিঃসরণ হতে পারে। পড়লেই একজন পাঠক বুঝতে পারবেন। বিস্তারিত নাইবা বললাম।
খুব মোলায়েম একটা গল্প "আমাদের দাদী"। অনেকে বেগম রোকেয়ার ছাপ পেতে পারেন। তবে অন্যগল্প আগে পড়ার কারণে লেখকের নিজস্বতা বুঝতে অসুবিধা হবে না।
"পাখির বাসা" গল্পটি এই গল্পগ্রন্থের একটু ব্যতিক্রমধর্মী গল্প। পড়তে পড়তে নারায়ণ স্যানালের "না মানুষের কাহিনীর" আর্টিক টার্নদের কথা মনে পড়ছিল। আবার খানিক আহমদ ছফার "পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ" বইটির স্মৃতি উস্কানি পাচ্ছিল। প্রকৃতির রূপ, সৌন্দর্য, আর নৃশংসতা নিয়ে সুন্দর একটা গল্প। এই একটা গুল্পেই সম্ভবত লেখক মানুষদের রেহাই দিয়েছেন।
এইবার একটু সত্য সমালোচনা করি। লেখাগুলো বর্ণনামূলক হবার কারণে এক বসায় পড়তে গেলে বেশ একঘেয়েমি লাগবে। মনে একই ধরনের কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা শুধু। তাই আমার ব্যক্তিগত সাজেশন থাকবে কোন উপন্যাসের ফাঁকে ফাঁকে পড়ার। তাহলে বিরক্তি এড়িয়ে গল্পগুলির মূলকথা বোঝা সহজ হবে। যা বর্তমান সময়ের জন্য ভীষণ প্রাসাঙ্গিক। মুক্তচিন্তাকে সরাসরি ভরকেন্দ্র রেখে এমন গল্পলেখার ধারণাটা সত্যি নতুন। তবে লেখকের কাছে ক্ষুদ্র পাঠক হিসাবে আমার নিবেদন যে, এই ভাষা এবং ভরকেন্দ্রকে অটুট রেখে সংলাপযুক্ত একটি গল্পগ্রন্থ আমাদের উপহার দিবেন।
মহিউদ্দিন মোহাম্মদ বয়সে আমার অনেক ছোটো হবেন। কিন্তু তিনি এতো দূরদর্শী লেখক তা ভাবতে পারি নি। একটা স্যাম্পল দেই দেখেনঃ তিনি তার " ড্রাইভিং লাইসেন্স" গল্পের এক জায়গায় মিরপুর বিআরটিএ অফিসের এক দালালের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন
"লোকটি পাকা ম্যানেজারের মতোই কাজ করিলো। দুই দিনেই লার্নার কার্ড বাহির করিয়া দিয়া আবদাল মিয়াকে ব্যবহারিক পরীক্ষার তারিখ জানাইয়া ফেলিলো। যে-কাজে এক কোটি প্রকার কাগজপত্র লাগিবার কথা, সে-কাজ দালালটি মাত্র তিন-চারটি কাগজযোগেই সম্পাদন করিলো। এরকম একটি কাজের লোক দেশের অর্থমন্ত্রী হইলে উপকার হইতো। ফরম পূরণ করিবার ভয়ে যাহারা ভ্যাট-ট্যাক্স দিতেছে না, কী জানি কী হয় ভাবিয়া যাহারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড হইতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখিতেছে, তাহারা দুই লাইনের একটি সিম্পল ডিক্লারেশন ফর্ম জমা দিয়া সরকারের ক্যাশভাণ্ডার বৃদ্ধি করিতো। বলিতো, ‘আমি অমুক, পরিচয়পত্র নম্বর এই, গেলো বছর আট লক্ষ টাকা উপার্জন করিয়াছি, আজ করযোগ্য আয়ের পাঁচ শতাংশ খুশিমনে রাজকোষে জমা দিলাম।’ অথবা বলিতো, ‘এ বছর তেমন আয়-উন্নতি হয় নাই, লোকসানে পড়িয়া কষ্টে দিনাতিপাত করিতেছি, তাই কোনো কর জমা দিতে পারিলাম না। যদি সম্ভব হয়— কিছু নগদ টাকা পাঠাইয়া সাহায্য করিবেন।’ না, আবদাল মিয়া ভাবিলেন, এরকম একটি করিৎকর্মা লোক দেশের অর্থ মন্ত্রণালয় কোনোদিন পাইবে না। প্রতিভাবান সকলেই কেমন জানি ভাগ্যের পাকে পড়িয়া বিআরটিএ’র দালালি করিতেছে। পেটের অত্যাচারে ভুল জায়গায় ম্যানেজারি ফলাইতেছে। আর ওইদিকে চতুরেরা, শক্তির মন্দিরে গলার আওয়াজ বলি দিয়া দিয়া, দেবতার আজ্ঞাবহ একনিষ্ঠ ভারবাহী পূজারী সাজিয়া, মন্ত্রিত্ব তথা দেশের ম্যানেজারি ভাগাইয়া লইতেছে।" (পৃষ্ঠা ৯৯, গল্পের বইয়ের নাম 'টয়োটা করোলা')
কী লিখেছে বুঝতে পারছেন? এই সামান্য কয়টা লাইনে তিনি এনবিআরের রাজস্ব সংকটের মূল কারণ আর সমাধান দেখিয়ে দিছেন, তাও একটা ফিকশোনাল চরিত্রের সাহায্যে। মহিউদ্দিন মোহাম্মদের নিন্দুকদের বলতে চাই, তার সাহিত্যকর্ম বুঝতে আপনাদের আরও ৫০০ বছর লাগবে নিদেনপক্ষে। আপনারা আরও ১০০ বছর প্রেম ছ্যাকা ন্যাকামো আর গরিবি সাহিত্য নিয়েই মাতামাতি করবেন। তারপর হুশ ফিরলে মাতবেন মহিউদ্দিন মোহাম্মদ নিয়ে। লেখক মহিউদ্দিন মোহাম্মদের আরও বইয়ের জন্য এই মুগ্ধ পাঠক অপেক্ষা করছি।
বইটা পড়ে শেষ করলাম। ভাষার মুন্সিয়ানার প্রশংসা করে শেষ করা যাবেনা, আর গল্পগুলা অভিনব এই অর্থে যে এইখানে অনেক জড় বিষয়আশয়কে লেখক কন্ঠ দান করেছেন। একটা গাড়ির কন্ঠে আমরা বাংলাদেশের সমাজকে দেখতে পাবো, এই থিমটা বাংলা সাহিত্যের জন্য আসলেই অভিনব। একেকটা গল্পে লেখক একেক জিনিসকে খোঁচা মেরেছেন। মসজিদের চিঠি গল্পে যেভাবে মুসল্লিদের আমলনামা তুলে ধরেছেন তা আমাকে অবাক করেছে। বস্তাপচা সাহিত্যের যুগে মহিউদ্��িন মোহাম্মদের এই বই এক টুকরা সোনা। সাহিত্যের মাধ্যমে জাতিকে আলো দেখানোর কাজটা তিনি ভাল করেই করেছেন মনে হয়েছে। অবশ্য লেখকের আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র বইটা পড়েই এই ইঙ্গিত টের পেয়েছিলাম। লেখকের কথা অংশটা পড়ে অনেক কিছু জেনেছি, সম্ভবত লেখক প্রচুর পড়াশোনা করেন। তবে মাশরুর আরেফিনদের মতো তিনি নেইম-ড্রপিং করেন না, অপ্রাসঙ্গিকভাবে পণ্ডিতি দেখান না। তার নিজস্ব চিন্তা করার ক্ষমতা আছে, এটা স্বীকার করতে হবে। ���শ্বরের টেলিফোন, মানুষ ও বানরের পার্থক্য, পাখির বাসা, এই গল্পগুলোতে লেখকের ফিলোসোপি সম্পর্কে কিছু ধারণা পেয়েছি, লেখক প্রকৃতি প্রেমিক এবং সমাজে পারস্পরিক সহনশীলতার ব্যাপারে সোচ্চার। ভণিতা গল্পে নারীর অধিকার বিষয়টা খুব কড়া ভাষায় ফুটিয়ে তুলছেন। দরখাস্ত আর ড্রাইভিং লাইসেন্স আর দেশটি নষ্ট হইয়া গেলো এই তিনটা গল্প পড়ে খুব হাসছি। বহুদিন পর এমন ভালো মানের একটা গল্পের বই পড়লাম। যারা ভাবতে চান বা কোনো বিষয়কে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে চান তাদের জন্য এ বই মাস্ট-রিড। মহিউদ্দিন মোহাম্মদের লেখা অত্যন্ত উপভোগ্য ও সাবলীল, পাঠকের সাথে তিনি দারুণভাবে কমিউনিকেট করতে জানেন, এবং একইসাথে তার লেখার মান ও ভাষা খুব উন্নতমানের। রবীন্দ্র-নজরুলের পরবর্তী যুগে যে গ্যাপ বাংলা সাহিত্য তৈরি হইছিলো তা সম্ভবত মহিউদ্দিন মোহাম্মদের হাত দ্বারা পূর্ণতা লাভ করবে। তার পরবর্তী বইগুলোর অপেক্ষায় থাকলাম।
এ বই বেশ ক্লাসি রিডারদের জন্য!! অন্তত শরৎ বা রবীন্দ্রনাথ পড়া না থাকলে এ বই কেউ পড়ে বুঝবে বলে মনে হয় নাই। পড়তে খুব ভাল লেগেছে এবং প্রতিটা গল্পেই লেখকের চিন্তাশক্তি আমাকে মুগ্ধ করেছে। খুব ভিন্ন ধাঁচের গল্প লেখনী, আর গল্পের কাহিনীর চেয়ে ভাষার কারুকাজ আর বর্ণনাটা বেশি ইন্টারেস্টিং। তবে সবার এই বই ভাল লাগবেনা। ১৩ টা গল্পের অন্তত ৮ টা পড়ে অনেকের অনুভূতি আহত হতে পারে বা খোঁচা লাগতে পারে। ঈশ্বরের টেলিফোন গল্পটা দুঃসাহসী বটে এই দেশের প্রেক্ষাপটে। বিজ্ঞান ছাড়া একদিন পড়ে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর এ বই ভাল লাগবেনা। তবে চোখ খোলার আগ্রহ থাকলে ভাল লাগবে। লেখকের ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠো রে বইটা পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।
বিদ্রঃ এটা সেই অর্থে রিভিউ নয়। এই বইয়ের রিভিউ দেওয়ার সাহস আমার নেই শুধু পাঠ অনুভূতি প্রকাশ করলাম। রউফুল স্যার বলেছিলেন মহিউদ্দিন মোহাম্মদ যুগন্ধর হবেন আর একটা নতুন যুগের সূচনা করবেন। এটাই যেন হতে যাচ্ছে। উনাকে চিনি মূলত আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র বইয়ের মাধ্যমে নন-ফিকশন রাইটার হিসেবে। উনার কাছ থেকে যে গল্পগ্রন্থ পাব এটা আশা ছিল না। এখন মনে হচ্ছে উনার লেখা গল্পগুলাই সমকালীন পড়া সবচেয়ে ভাল গল্প আর উনি উপন্যাস লেখলে তা খুবই খুবই ভাল উপন্যাস হবে। প্রলিফিক রাইটার কথাটার যোগ্য লেখক মহিউদ্দিন মোহাম্মদ।
গার্সিয়া মার্কেজের সেই অমর বাণী মনে আসছে এ বই পড়ে যেহেতু লেখকের আগের বইটা পড়েছি। মার্কেজ বলেছিলেন একজন লেখক একই বই ভিন ভিন্ন ভাবে লেখেন। মার্কেজের বইগুলাতে যেমন একই থিম নানা আঙ্গিকে বারবার এসেছে মহিউদ্দিন মোহাম্মদের বইয়েও যেন তেমনি ঘটেছে। এ বইয়ের তিন-চারটা গল্পের থিম আধুনিক গরু রচনা সমগ্র বইয়ের কিছু কিছু কথার বিস্তারিত বয়ান এবং এ বয়ানে লেখক যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তা অত্যন্ত চমৎকার ও প্রশংসাযোগ্য। ভাষার এক্সপেরিমেন্টটাও চোখে পড়ার মতো। কয়েকটা গল্প পড়ে কেউ কেউ আহত হতে পারেন, কিন্তু চোখ কান খোলা রেখে পাঠ করলে চিন্তাভাবনার যথেষ্ট খোরাক পাওয়া যাবে নিঃসন্দেহে। প্রায় প্রতিটা গল্পেই কোট করার মতো প্যারা আর লাইন রয়েছে, মনে হলো অনেকদিন পর ক্লাসিক কোনো বাংলা গল্প বা উপন্যাস পড়ার স্বাদ পেয়েছি। প্রণয়ের ঘ্রাণ শুঁকিতে এ অঞ্চলে কুকুরদের বিশেষ সুনাম রহিয়াছে... এরকম একট��� লাইন জার্নি বাই বাস গল্পে পেয়েছি যা মাথায় এখনো বাজতেছে। এই লেখক বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে টেনে নিয়ে যেতে পারে বলে মনে হয়েছে।
বইয়ের নাম : টয়োটা করোলা লেখক : মহিউদ্দিন মোহাম্মদ . . . বেশ কয়দিন আগেই পড়া হয়েছে বইটি কিন্তু রিভিউ লিখতে আলসেমি লাগছিল। আজকে ফোনের গ্যালারি ঘাটতে যেয়ে এই বইটির কিছু ছবি তুলেছিলাম তা পেয়ে গেলাম।তাই ভাবলাম রিভিউ টা দিয়েই দি। . . বইটিতে ১৩ টি ছোট গল্প আছে। প্রথম গল্পটি পড়েই বুঝতে পারলাম সাধারন যে ধরনের বই পড়া হয় তার কোনটির সাথে এই লেখার মিল নেই। কোন প্রকার তেল মসলা বিহীন লেখা। সোজা সাপ্টা কড়া লেখা। বইয়ের লেখা গুলো সব গায়ে এসে লাগার মূল কারণ হলো বইটি সাধু ভাষায় লেখা। খুবই মজা লেগেছে পড়তে এবং বেশ কয়েকটা গল্প ভাবিয়েছে। . . আমি লেখকের প্রথম বই " আধুনিক গরু-রচনা সমগ্র" না পড়েই এই বইটি পড়েছি। এই বইটি কেনার মূল কারণ ছিল বইটির নাম। আমাদের একটা শখের গাড়ি আছে টয়োটা করোলা। তাই মনে হলো কিনে পড়ে দেখি। একটা মাস্টারপিস ঘরে নিয়ে এসেছি এতটুকুই বলতে চাই। এ ধরনের লেখা আরও প্রকাশিত হলে আমাদের দেশের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে বলে আমি মনে করি। . . Personal Ratings : 5/5
মোট তেরটি গল্প লইয়া লেখক বইটি সাজাইছেন। এরমধ্যে কতক তিনি লিখিয়াছেন সাধু ভাষায় এবং কতক চলিতে। অরুণ মিত্রের মতো তিনিও বলিতে চাইছেন, ‘আমি বিষের পাত্র ঠেলে দিয়েছি/ তুমি প্রসন্ন হও।’
বই পড়ে আমি প্রসন্ন হয়েছি। গল্প বলার এ ধরন কিন্তু নতুন নয়। আগেও পড়েছি, খুব সম্ভবত পত্রিকায়। বিষদ লেখা হয়নি অবশ্য এ ধারায়। তাই, নতুন লাগতে পারে অনেকের কাছে।
কে বা কাহারা একটি পুকুর খনন করিয়াছিল, কোনো একসময়। অনেকদিন হইয়া যাওয়ার ফলে তাহার মনও কিছু দুঃখের ঘটনা বলিতে আকুল হইয়া উঠে।
তেমনি পুরোনো আরেকখানা মসজিদ, যাহার চালা ছিল টিনের, বেড়া ছিল শণের। সেই মসজিদ বহাল তবিয়াতে থাকলেও তাহার পাশে আরেকখানা মসজিদ তৈয়ার হইয়াছে। যাহায় রহিয়াছে এয়ারকন্ডিশন পর্যন্ত। সেই শণের মসজিদেরও একটি চিঠি রইয়াছে আপনাদের জন্য।
এক লোকের একদা মনে হইল, দেশটি নষ্ট হইয়া গ্যাছে। সে তাহাও বর্ণন করিতে চায় আপনাদিকে।
আবার ইহা পড়িলে আপনারা জানিতে পারিবেন, মানুষ ও বানরের পার্থক্য কোথায়? ঈশ্বরের টেলিফোনও পাইবেন। চাকরির সার্কুলার পাইবেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে।
চলিতে পারিবেন বিজ্ঞান ছাড়া একদিন। জাপান হইতে টয়োটা করোলা বাংলাদেশের সিটিজেন নিল কীভাবে সেই ঘটনাও জানিতে পারিবেন।
একটি মেয়েকে আপনি কীভাবে আপন করে নেওয়া যায়, সেই ঘটনাও জানতে পারবেন। সবশেষে কাগজের কীরূপ মূল্য আপনি জানেন কিংবা জানেন না, তা দেখতে পারবেন।
আমাদের চারপাশের খুব সাধারণ অনেক বিষয় নিয়ে গল্প। চমক সৃষ্টির মত কোনো কাহিনি যারা চান তাদের জন্য এই বই নয়, কিন্তু এত সুন্দর আর স্টাইলিশ ভাষার কারুকাজ যে বারবার পড়তে মন চায়। ঈশ্বরের টেলিফোন গল্পটা আর বিজ্ঞান ছাড়া একদিন গল্পটা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভাল লাগছে। তবে সব গল্পেরই ন্যারেটিভ অন্যরকম। এক কথায় বললে লেখক অধিকাংশ গল্পে নন-ফিকশনকে ফিকশনালাইজড করেছেন। যারা সাহিত্যের অনুরাগী তাদের জন্য এই বই।
সাধারণ মানুষের কিছু অব্যক্ত কথা যেগুলো প্রায় সবাই বলতে চায়, কিন্তু শব্দ চয়ন এবং কিছুটা বীরত্বের অভাবে হয়তো লেখার সুযোগ হয়ে ওঠেনি, সেগুলো লেখক এখানে নিজের মতো করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
মোট ১৩টি ছোটগল্পের মধ্যে সামাজিক বি��িন্ন অসঙ্গতি, দুর্নীতি, কুসংস্কার, এবং অন্ধ-ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
তবে লেখকের শব্দ চয়নের মধ্যে বেশ ঔদ্ধত্য, সবজান্তা, কিংবা কিছু বেহায়াপনাকেও নিজের মতো করে বৈধতা দেওয়া চেষ্টা, লক্ষ করা যায়।
স্যাটায়ারধর্মী লেখা গল্পগুলোতে ভাবনার খোড়াক ছিল অনেকই। সচেতন ও চিন্তাশীল যেকোনো পাঠকের কাছে গল্পগুলো ভালো লাগবে। ধর্মীয় সংকীর্ণতা, সামাজিক অসামাজিকতা ও অবিজ্ঞানমুখী কূপমণ্ডূকতা নিয়ে বেশ ভালো কিছু বিদ্রুপাত্মক গল্প রয়েছে৷ লেখকের লেখায় মুন্সিয়ানার ছাপ বিদ্যমান। রুচিশীল পাঠকদের ভালো লাগবে বলে আমার বিশ্বাস।
বইটা চমক জাগানিয়া বা থ্রিলিং টাইপের না। বইমেলায় বউয়ের হাতে উপহার হিসাবে পেয়ে ভাবছিলাম টয়োটা করোলা আবার কি নামরে বাবা!! লেখকের কথা অংশটা পড়েই ভাবলাম ভিতরে রত্ন আছে...... অনুমান ভুল হয় নাই। লেখককে ধন্যবাদ। তবে বইটা সবার ভাল লাগবেনা। ভাল লাগা না লাগা দিয়ে এই বই বিচার করলে ভুল করবেন সবাই। সব গুলা গল্পই বর্ণনামূলক। শেষ হইয়াও হইলো না শেষ এরকম।
বছরের প্রায় ৩টি মাস অতিবাহিত হতে চললো, কিন্তু আমার বই পড়া এগুচ্ছে না। সবমিলিয়ে সম্পূর্ণ কোন বই পড়ে শেষ করা হয়নি৷ এমনি অনেকগুলো বই একটু একটু করে পড়া হয়েছে। তবে এটাই এ বছরের পড়া আমার ১ম বই....
ছোট করে বললে বইটা খুব সুন্দর। গল্পগুলো চমকপ্রদ, লেখনশৈলী অভিনব। বইটির সথে সাথে উপভোগ্য সময় অতিবাহিত হয়েছে।
এই বইটা সবার ভাল লাগবে না। গল্পের বই হলেও এটাকে নিছক গল্পের বই বলতে রাজি নই। গল্পগুলোতে চিন্তাভাবনার খোরাক আছে, ভাষার কারুকাজ অত্যন্ত নান্দনিক। সবচেয়ে ভাল লেগেছে মানুষ ও বানরের পার্থক্য, ঈশ্বরের টেলিফোন, পাখির বাসা, ড্রাইভিং লাইসেন্স, আর টয়োটা করোলা গল্পটা। যারা ভাল মানের সাহিত্য পড়তে আগ্রহী তাদের জন্য ১০/১০ রিকোমেন্ডেড।
পড়ার সময়ে কোন ভাবেই চাচ্ছিলাম না "আধুনিক গরু রচনাসমগ্র" বইয়ের সাথে তুলনা করতে, শতভাগ সফল হতে পারি নি, তাই হয়ত এই বইটা ঠিক "জমলো না" ধরনের থেকে গেলো। কিছু গল্প অনেক সুন্দর ছিলো, কি���্তু বেশিরভাগই একটু "কেমন যেন" ধরনের...